ঘরে দরজা ছিল না। ঘরের ফাঁকা জায়গা ঢেকে রাখতে হয়েছে নারিকেল পাতা দিয়ে। ঘরে ছিলো না চেয়ার-টেবিল কিংবা চৌকি। মেঝেতেই করতে হয়েছে পড়াশোনা। ভালো জামা-কাপড় পরিধান ছিলো স্বপ্নের মতো। প্রতিবেশির ছেলের লুঙ্গি পরে প্রথম স্কুলে যাওয়া তার। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কালাদহ ইউনিয়নের বিদ্যানন্দ গ্রামের দিনমজুর বাবার ছেলে ফখরুল আলমের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এভাবেই।
তবে এগুলো এখন অতীতের কথা। দিনমজুর বাবার এই ছেলে এখন বিসিএস ক্যাডার। ৩৬তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশকৃত হয়েছেন। দারিদ্র্যপীড়িত অতীত ভুলে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কালাদহ ইউনিয়নের বিদ্যানন্দ গ্রামে দারিদ্র্যপীড়িত ফখরুল। মা-বাবা মুখে ফুটিয়েছেন হাসি।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিদ্যানন্দ গ্রামে ফখরুল আলমের পুরোনো বাড়িটি এখন বহাল তবিয়েতই আছে। অদম্য এই যুবকের জীবনযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়িটি। অভাব অনটনের সংসারে চার ছেলে মেয়ে থাকলেও একজনকে পড়ালেখা করানোর সুযোগ করে দিতে পেরেছিলেন ফখরুলের বাবা। ভাগ্যবান সেই সন্তান হলেন একমাত্র ছেলে ফখরুল। নিজেরা কম খেয়ে-কম পরে ছেলের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন মা-বাবা।
ফখরুল তার সেই অতীতের স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন, ‘আমার বয়স সতেরো হওয়া পর্যন্ত ঘরে কোনো দরজা ছিলো না। বাঁশ আর নারিকেল পাতা দিয়ে আব্বা ঢাকনা টাইপের কিছু একটা বানিয়ে দিয়েছিলেন। রাতে ওটাকে দরজা হিসেবে ব্যবহার করতাম আমরা। যে ঘরের দরজাই নেই, সেখানে চেয়ার-টেবিলে বসে পড়ার চিন্তা তো সুখকল্পনা মাত্র। মেজেতে ঝুঁকে পড়তে পড়তে ঘাড়ে ব্যথা করতো আমার। আর পারছিলাম না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আব্বা বাজার থেকে ৬০ টাকা দিয়ে একটা চেয়ার কিনে দিছিলেন।’
প্রথম হাইস্কুলে যাওয়ার কথা মনে পড়ে আজকের এই শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশকৃত ফখরুল আলমের। তিনি বলেন, ‘পরিবারের অবস্থা এতই শোচনীয় ছিলো যে, স্কুলে পরে যাওয়ার মতো একটা ভাল লুঙ্গিও ছিল না আমার। মা পাশের বাড়ির মেম্বারের ছেলের একটা লুঙ্গি এনে দিয়েছিলেন। সেই লুঙ্গি পরেই ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ক্লাস করতে গেছি।’
এতদূর আসার পেছনে ফখরুল সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব বাবাকে দিয়ে বলেন, ‘কারো অবদানের কথা বলতে গেলে অবশ্যই বাবার কথা বলতে হবে। উনি কোনোদিন একশো টাকা দিয়ে একটা লুঙ্গি কিনে পড়তে পারেননি। কখনো বাবাকে নতুন জামা পড়তে দেখিনি। উনি যা কিছু করেছেন সব আমার জন্যই করেছেন। পড়াশুনার ব্যপারে সবসময় উৎসাহ দিতেন আমাকে।’
ছেলের এগিয়ে যাওয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাবা ফজলুল হক ও মা মনোয়ারা বেগম। ভাবতেন, বড় হয়ে তাদের ফখরুল একদিন মুখ উজ্জল করবে সবার। ভেজা কণ্ঠে মা মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘মুরগি যে ডিম পাড়তো সেগুলো ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারতাম না। সেগুলো দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে তারপর সেগুলো বিক্রি করে ওর পড়ার খরচ দিতাম। আমার সন্তানদের ভালো খাবার দিতে পারিনি কখনো। তার বাবা গমের বিনিময়ে রাস্তার কাজ করতো আর সে গমের আটা দিয়ে তৈরী রুটি সকালে খেয়ে স্কুলে যেত আবার স্কুল থেকে ফিরে এসে সেই রুটি খেতো।’
বৃষ্টির রাতে ঘরের চালা বেয়ে পানি পড়তো। ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘরের এক কোণে রাত টাকাতেন মনোয়ারা বেগম ও ফজলুল হক। দারিদ্র্যপীড়িত সংসারে বড় দুই মেয়েদের পড়াশুনা করাতে না পেরে অল্প বয়সেই বিয়ে দেন পাশের গ্রামের কৃষক পরিবারে। ছোট মেয়ে সোমা আক্তার মাধ্যমিক পাশ করার পর তাকেও বিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের অভাব অনটন নিরসনে আয়রোজগারে লাগাতে ছেলেকে গার্মেন্টসে পাঠাতে বলেছিলেন প্রতিবেশীরা। সে কথায় কান না দিয়ে ছেলের পড়াশুনার খরচ যোগাতে হাসি মুখে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন ফজলুল হক।
সেই কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার সফলতায় মুগ্ধ ফজলুল হক বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে বাড়িতে আসার সময় ছেলের জন্য দুই টাকা দিয়ে রুটি কিনে নিয়ে আসতাম। অনেক দূরে হাই স্কুলে যাওয়া আসা করতো তাকে একটি সাইকেলও কিনে দিতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে ছেলে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছে। এখন চাকরিও পাইছে। আল্লাহর কাছে আমি শুকরিয়া আদায় করি।’
বিদ্যানন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে জনতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ফুলবাড়ীয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন অধম্য এই যুবক। এরপর ভর্তিহন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামীক স্ট্যাডিজ বিভাগে।
গত বছরের ১৭ জুলাই কৃষি ব্যাংকে যোগদানের পর আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসে পরিবারে। এখন আর তার বাবাকে কাজ করতে হয় না। ইতিমধ্যে পরিবারের জন্য নিজ বাড়িতেই একটি পাকা ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন ফখরুল।
জীবনযুদ্ধে জয়ী অদম্য ফখরুল আলম বলেন, দারিদ্রতা কোন সমস্যা নয়, মনের ইচ্ছা আর সৎ উদ্দ্যেশই পারে মানুষকে উচ্চ পর্যায়ে নিতে। যারা দারিদ্রতার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে তাদের জন্য কাজ করতে চান তিনি।