রক্ত ও রক্ত সঞ্চালন, রক্ত চাপ, হৃদপিন্ড ও হৃদরোগ

রক্ত ও রক্ত সঞ্চালন

১. আকার, আকৃতি ও কাজের ভিত্তিতে রক্তবাহিকা – তিন রকম । যথাঃ
– ক. ধমনিঃ অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত হৃদপিণ্ড থেকে সারা দেহে নিয়ে যায় ।
– খ. শিরাঃ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ রক্ত হৃদপিণ্ডে নিয়ে যায় ।
– গ. কৈশিক জালিকাঃ ধমনি ও শিরার সংযোগকারী কতগুলো জালিকাকার সুক্ষ্ম রক্তনালী। ব্যাপন প্রক্রিয়ায় পুষ্টি দ্রব্য ও অক্সিজেন আদান-প্রদান করে।
২. রক্ত কী – লাল বর্ণের অস্বচ্ছ,আন্তঃকোষীয় লবণাক্ত ও ক্ষারধর্মী তরল যোজক টিস্যু।
৩. একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে রক্ত থাকে প্রায় – ৫ থেকে ৬ লিটার। যা মানুষের দেহের মোট ওজনের ৮%
৪. রক্তের রং লাল কারণ – রক্তে হিমোগ্লোবিন নামক লৌহঘটিত প্রোটিন জাতীয় পদার্থ থাকে।
৫. রক্তের প্রধান উপাদান – রক্তরস/প্লাজমা(৫৫%) এবং রক্তকণিকা(৪৫%);রক্তরসে পানি থাকে ৯০%
৬. রক্তের অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে – রক্তরস
৭. রক্তরসের প্রতিরক্ষামূলক দ্রব্যাদি – অ্যান্টিটক্সিন ও অ্যাগ্লুটিনিন

৮. রক্তকণিকা প্রধানত – তিন প্রকার
– ক. লোহিত রক্ত কণিকা / এরিথ্রোসাইট – দ্বি-অবতল ও চাকতি আকৃতির/চ্যাপ্টা আকৃতির
– খ. শ্বেত রক্ত কণিকা / লিউকোসাইট – নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই ; অ্যামিবার মতো দেহের আকার পরিবর্তন করতে পারে।
– গ. অণুচক্রিকা / থ্রম্বোসাইট/প্লেইটলেট – গোলাকার,ডিম্বাকার বা রড আকৃতির হতে পারে
৯. লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয় – অস্থিমজ্জায়
১০. লোহিত রক্তকণিকা সঞ্চিত হয় – প্লিহায়(spleen)
১১. লোহিত রক্তকণিকার আয়ু – ১২০ দিন বা চার মাস ; এতে হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকায় এদের বর্ণ লাল হয়। এজন্য এদের Red Blood Cell বা RBC বলে।
১২. স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্তে লোহিত কণিকা – নিউক্লিয়াসবিহীন। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর রক্তের লোহিত কনিকায় নিউক্লিয়াস থাকে।
১৩. শ্বেত রক্তকণিকায় – নিউক্লিয়াসযুক্ত বড় আকারের কোষ।এগুলো হিমোগ্লোবিনবিহীন বিধায় শ্বেত/সাদা/ White Blood Cell(WBC)
১৪. ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ধ্বংস করে – শ্বেত রক্তকণিকা। ফ্যাগোসাইটোসিস হলো অ্যামিবার মতো দেহের আকার পরিবর্তন করে ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে রোগজীবাণু ভক্ষণ ।
১৫. শ্বেত রক্তকণিকার গড় আয়ু – ১ থেকে ১৫ দিন

১৬. গঠনগতভাবে বা সাইটোপ্লাজমে দানার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি অনুসারে শ্বেত রক্তকণিকা – দুই প্রকার
ক. অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন – এর আবার দুই প্রকার । লিম্ফসাইট ও মনোসাইট । এই মনোসাইটই মূলত ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রোগজীবাণু ধ্বংস করে। আর লিম্ফসাইট অ্যান্টিবডি গঠন করে।
খ. গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত – এরা আবার নিউক্লিয়াসের আকৃতির ভিত্তিতে তিন প্রকার।
– নিউট্রোফিলঃ ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রোগজীবাণু ধ্বংস করে
– ইওসিনোফিলঃ হিস্টামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে এলার্জি প্রতিরোধ করে
– বেসোফিলঃ হেপারিন নিঃসৃত করে যার ফলে রক্ত রক্তবাহিকার ভিতর জমাট বাঁধে না। ইহাও হিস্টামিন নিঃসৃত করে এলার্জি প্রতিরোধ করে।

১৭. অণুচক্রিকা গড় আয়ু – ৫ থেকে ১০ দিন
১৮. অণুচক্রিকার প্রধান কাজ – রক্ততঞ্চন /রক্তজমাট(Blood Clotting)
১৯. ফাইব্রিন – এক ধরণের অদ্রবণীয় প্রোটিন যা দ্রুত সুতার মত জালিকা প্রস্তুত করে রক্ততঞ্চন ঘটায়।
২০. রক্ততঞ্চনে সাহায্য করে – ভিটামিন K এবং ক্যালসিয়াম আয়ন
২১. পারপুরা কি – অণুচক্রিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। জেঙ্গুজ্বর হলে এই অবস্থা হয়।
২২. থ্রম্বোসাইটোসিস কী – অণুচক্রিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। ফলে রক্তনালীর অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বেঁধে যায় । একে থ্রম্বোসিস বলে ।
২৩. পলিসাইথিমিয়া – লোহিত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাওয়া
২৪. এনিমিয়া – লোহিত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যাওয়া
২৫. লিউকেমিয়া/ ব্লাড ক্যান্সার – শ্বেত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যধিক বেড়ে যায় । সাধারণত ৫০,০০০-১০,০০,০০০
২৬. লিউকোসাইটোসিস – শ্বেত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় । সাধারণত ২০,০০০-৩০,০০০ । নিউমোনিয়া হুপিংকাশিতে এই অবস্থা হয়। রোগের বিরুদ্ধে শরীরে ইমুনিটি তৈরির জন্য।
২৭. থ্যালাসিমিয়া – বংশগত রক্তের রোগ। রক্তের হিমগ্লোবিনের পরিমাণ কমে রক্তশূন্যতার সৃষ্টি করে । রোগীকে প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। বাবা ও মায়ের অটোজোমে বিদ্যমান প্রচ্ছন্ন জিন একত্রিত হয়ে সন্তানে এই রোগ সৃষ্টি করে।
২৮. মানুষের রক্তে এন্টিজেন – ২ ধরনের
২৯. সিরাম কী – রক্ত জমাট বাঁধার পর রক্তে হালকা হলুদ যে স্বচ্ছ রস নিঃসৃত হয়। তাই সিরাম ।সিরামে কোন রক্ত রস থাকে না । সিরামে ২ ধরণের এন্টিবডি আছে ।
৩০. Rh factor কী – রেসাস(Rhesus) নামক বানরের লোহিত কনিকায় অবস্থিত একধরণের অ্যাগ্লুটিনোজেন/অ্যান্টিজেন । স্বামী – স্ত্রী একই Rh factor(হয় Rh positive নয় Rh negative) যুক্ত না হলে অনাগত সন্তানের নানান জটিলতা দেখা দেয়।

রক্ত চাপ
১. রক্তচাপ কী – হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে রক্ত ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহকালে ধমনি প্রাচীরে যে পার্শ্বচাপ সৃষ্টি হয়, তাকে রক্তচাপ বলে।
২. রক্তচাপ মাপা হয় – স্ফিগমোম্যানোমিটার নামক যন্ত্র দিয়ে
৩. স্বাভাবিক রক্তচাপকে প্রকাশ করা হয় – ১২০/৮০ mm Hg
৪. সিস্টোল(Systole) কী – হৃদপিণ্ডের স্বতঃস্ফূর্ত সংকোচন
৫. ডায়াস্টোল(Diastole)কী – হৃদপিণ্ডের স্বতঃস্ফূর্ত প্রসারণ
৬.সিস্টোলিক রক্তচাপ কী – সিস্টোল অবস্থায় ধমনিতে যে চাপ থাকে, তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ বলে।একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সিস্টোলিক রক্তচাপ ১১০-১৪০ mm Hg
৭. ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কী – ডায়াস্টোল অবস্থায় ধমনিতে যে চাপ থাকে, তাকে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বলে।একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৬০-৯০ mm Hg
৮. উচ্চরক্তচাপকে ডাক্তারি ভাষায় বলে – হাইপারটেনশন । সিস্টোলিক রক্তচাপ সবসময় ১৬০ mm Hg বা তার বেশী এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ সবসময় ৯৫ mm Hg বা তার বেশী হলে একে উচ্চরক্তচাপ বলে।

হৃদপিণ্ড এবং হৃদরোগ
১. হৃদপিণ্ড অবস্থানঃ ফুসফুস দুটির মাঝে ও মধ্যচ্ছদার উপরে।
২. মানুষের হৃদপিণ্ড যে পর্দা দিয়ে বেষ্টিত – দ্বিস্তরী পেরিকার্ডিয়াম পর্দা । উভয় স্তরের মাঝে থাকে পেরিকারডিয়াল ফ্লুইড যা হৃদপিণ্ডকে সংকোচনে সাহায়্য করে।বাইরের স্তরকে বলে fibrous এবং ভেতরের স্তরকে বলে serous .
৩.মানুষের হৃদপিণ্ড – চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট । উপরের প্রকোষ্ঠ(chambers) দুটিকে ডান ও বাম অলিন্দ(Atrium) এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান ও বাম নিলয়(Ventricle) বলে। অলিন্দের প্রাচীর পাতলা। নিলয়ের প্রাচীর পুরু ও পেশিবহুল। অলিন্দ দুটি আন্তঃঅলিন্দ পর্দা এবং নিলয় দুটি আন্তঃনিলয় পর্দা দিয়ে পৃথক থাকে।
৪. প্রকোষ্ঠগুলোর কাজ ও সংযুক্তি
ক. বাম অলিন্দ- চারটি পালমোনারি শিরার সাথে যুক্ত
খ. ডান অলিন্দ – একটি ঊর্ধ্ব মহাশিরা এবং একটি নিম্ন মহাশিরা যুক্ত থাকে।
গ. বাম নিলয় – মহাধমনি উৎপত্তি
ঘ. ডান নিলয় – ফুসফুসীয় ধমনি উৎপত্তি
৫. ধমনি কী – যেসব রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত হৃদপিণ্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে বাহিত হয় ,তাকে ধমনি বা আর্টারি বলে।
৬. ধমনীর প্রাচীরে স্তর – তিনটি । প্রাচীর পুরু। কোন কপাটিকা থাকে না । ধমনি গহ্বর ছোট হয়।
৭. হার্ট ব্লক – হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ত্রুটিপূর্ণ হলে বা উৎপন্ন প্রবাহ সঠিক পথে পরিবাহিত না হলে তাকে হৃদ অবরোধ বা হার্ট ব্লক বলে।
৮.হার্ট অ্যাটাক- হৃদ পিণ্ডের করোনারী ধমনি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে হৃদপেশির রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়।
৯. হার্ট ফেলিওর – হৃদপিণ্ডের অলিন্দ অথবা নিলয় অথবা উভয়ের সংকোচন ক্ষমতা লোপ পাওয়াকে বলে হার্ট ফেলিওর।
১০. ECG কী – এর পূর্ণরূপ Electro cardiograph । হৃদপিণ্ড যখন স্পন্দিত হয় তখন এর বিভিন্ন অঞ্চলের পেশী থেকে যে বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি হয় তা গ্রাফ কাগজে লিপিবদ্ধ করা হয়।
১১. Electro cardiogram – হৃদপেশির ক্রিয়াপদ্ধতি রেকর্ড করার যন্ত্র
১২. কোলেস্টেরল কী – বিশেষ ধরণের স্নেহ/লিপিড/স্টেরয়েড জাতীয় পদার্থ । রক্তে স্নেহ পদার্থের বাহক হিসেবে কাজ করে।
রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য হৃদ রোগের আশংক্ষা বাড়ায়।
১৩. রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা – ১০০ থেকে ২০০ mg/dl । mg/dl পূর্ণরূপ Milligrams per Deciliter
১৪. লাইপোপ্রোটিন কী- স্নেহ ও প্রোটিন এর যৌগ। স্নেহের পরিমানের উপর ভিত্তি করে লাইপোপ্রোটিন দু রকম।
ক. উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট লাইপোপ্রোটিন(HDL-High Density Lipoprotein) / বেশী থাকা শরীরের জন্য উপকারী
খ.নিম্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট লাইপোপ্রোটিন(LDL-Low Density Lipoprotein)/ বেশী থাকা শরীরের জন্য ক্ষতিকর / LDL < 150 mg/dl হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।
১৫. ধমনীর কাঠিন্য(Arteriosclerosis) কী – রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে রক্তনালীর অন্তঃপ্রাচীরের গাত্রে কোলেস্টেরল ও ক্যালসিয়াম জমা হয়ে রক্তনালী সংকুচিত হয় । ফলে ধমনি প্রাচীরের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং শক্ত হয়ে যায়। ফলে ধমনি গাত্রে ফাটল দেখা দেয়। ফাটল দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে জমাট বেঁধে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
১৬. করোনারি থ্রম্বোসিস – হৃদপিণ্ডের করোনারি রক্তনালিকায় রক্ত জমাট বাঁধা
১৭. সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস- গুরু মস্তিষ্কের রক্তনালিকায় রক্ত জমাট বাঁধা
১৮. হার্টবিট বা পালসরেট কাউন্ট করা হয় – হাতের রেডিয়াল ধমনিতে/কণ্ঠনালিতে/ সরাসরি বুকে কান পেতে । পালসের স্বাভাবিক গতি ৬০-১০০ বার প্রতি মিনিটে
১৯. প্রতি মিনিটে পালসের গতি ৬০ এর কম হতে পারে – হার্ট ব্লক বা জন্ডিসের কারণে
২০. ১০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়ার জন্য পালসের গতি বাড়ে – প্রতি মিনিটে ১০ বার
২১. প্রতি মিনিটে পালসের গতি ১০০ এর বেশী হতে পারে – জ্বর ও শক(অচেতনতা) ও থাইরয়েড গ্রন্থির অতিকার্যকারিতার কারণে ।
২২. ফুসফুসীয় ধমনির কাজ কী – কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত রক্ত হৃদপিণ্ড থেকে ফুসফুসে নিয়ে যায়।
২৩. পালমোনারি শিরার কাজ কী – অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত ফুসফুস থেকে হৃদপিণ্ডে নিয়ে যায়
২৪. শিরার প্রাচীন – পাতলা এবং ৩ স্তর বিশিষ্ট । গহ্বর বড় । কপাটিকা থাকে এর কারণে রক্ত একমুখে প্রবাহিত হয় ।
২৫. কৈশিক জালিকা গঠিত – এক স্তর বিশিষ্ট Endothelium দিয়ে
২৬. মানুষের হৃদপিণ্ড – মায়োজেনিক(Myogenic) । মানে বাইরের কোন উদ্দীপনা ছাড়া হৃদপেশী নিজে থেকে সংকোচন ও প্রসারণ করতে পারে ।

নিজের সুবিধামত পড়ার জন্য টাইমলাইনে শেয়ার করে রাখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 + 10 =